মোঃ আবু সাইদ শওকত আলী
ঝিনাইদহ জেলা প্রতিনিধি
সরকারি নথিতে গ্রামটির অস্তিত্ব আছে। আছে ফসলের জমি, গাছগাছালি। শুধু নেই কোন কোলাহল। মানুষের বসতি চিহ্ন হয়ে টিকে আছে ঘরবাড়ির কিছু ধ্বংসাবশেষ। তবে এক সময় গ্রামটি মেতে থাকতো মানুষের কোলাহলে। ছিল হিন্দু মুসলমানের স্থাবস্থান। উৎসব পালা-পার্বণ মাতিয়ে রাখত সারা বছর। সম্প্রীতির মেলবন্ধন ঘটানো এই গ্রাম উৎসব তো দূরের কথা, এখন কোন ঘরবাড়ির বালাই নেই। খাঁ খাঁ করছে চারদিক। এক সময়ের সমৃদ্ধ জনপদের চিহ্ন হিসেবে টিকে আছে পুরনো আমলের ঘরবাড়ির ইটের টুকরা, উঁচু ভিটা আর তিনটি পুকুর। মানুষ শূন্য এই গ্রামের নাম মঙ্গলপুর।
ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর উপজেলার এলাঙ্গী ইউনিয়নে এ গ্রামের অবস্থান। জনশ্রুতি আছে, বহু বছর আগে মঙ্গলপুর গ্রামের মানুষের মধ্যে অমঙ্গল আতঙ্ক ভর করে। ভয়ে তখন গ্রাম ছেড়ে চলে যায় মানুষ। মঙ্গলপুর থেকে মানুষজন চলে যাওয়ার এখনো পর্যন্ত দু'টি কারণ জানা গেছে। একটি কলেরা আরেকটি অমঙ্গলের ছায়া।
জানা গেছে কোটচাঁদপুর থেকে চৌগাছা উপজেলার যাওয়ার রাস্তা ধরে ৬ কিলোমিটার এগোলে হাতের বাঁয়ে মঙ্লপুর গ্রাম। মূল রাস্তা থেকে একটি পার্শ্বসড়ক মঙ্গলপুরের ভেতর চলে গেছে পাশের ত্রিলোচনপুর গ্রামের দিকে। এক হাজার মিটারের এ রাস্তাটি ইটের তৈরি। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে তৈরি করতে খরচ হয় প্রায় ৫৯ লাখ টাকা। এর আগে কাঁচা সড়ক ছিল মঙ্গলপুরের ভেতর দিয়ে। এর দু'পাশ জুড়ে এক সময় ছিল মঙ্গলদের বসবাস।
এলাঙ্গী এলাকার সুলতান মাস্টার বলেন, অনেক বছর আগে মঙ্গলপুর গ্রামে মহামারি আকারে কলেরা রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এতে অনেক মানুষ মারা যান। আতঙ্কে অন্যরা আশপাশের গ্রামে আশ্রয় নেন। কিছু পরিবার গ্রাম ছেড়ে ভারতে চলে যায়। স্থানীয় বাবর আলী জানান, মঙ্গলপুর গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ছিল হিন্দু সম্প্রদায়ের। গ্রামটিতে হঠাৎ কলেরা মহামারি আকার ধারণ করে। এতে মানুষ মারা যায়। এই সময়ে একটা কথা ছড়িয়ে পড়ে যে, খাল বিল, পুকুর, কুয়ার পানি নষ্ট হয়ে গেছে। এখানে থাকলে সবাইকে মরতে হবে। ভয়ে দলে দলে গ্রাম ছাড়তে শুরু করে মানুষ। পরে ওই গ্রামে আর ফিরে যাননি। স্থানীয় ইসাহক আলী জানান, মঙ্গলপুর বিরাট বড়গ্রাম ছিল। বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের মানুষের বসত ছিল সেখানে। গ্রামটি ঠাকুর সম্প্রদায়ের বেশ প্রভাব ছিল। হাওলা ঠাকুর, লেটো ঠাকুরের বংশ ধরেরা এখানে বসবাস করতেন। হঠাৎ গ্রামে অমঙ্গলের ঘটনা ঘটতে থাকে। এরপর একে একে সবাই গ্রাম ছেড়ে যান। সিরাজুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি বলেন।
মঙ্গলপুরে মঙ্গল নামে এক হিন্দু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। এক রাতে এলাকা ছেড়ে অজানা গন্তব্যে চলে যায় মঙ্গল পরিবারগুলো। একে একে অমঙ্গলের ঘটনা ঘটতে থাকে মঙ্গলপুর গ্রামে। কিছুকালের মধ্যেই গ্রামটি হয়ে পড়ে জনমানব শূন্য। পুরো গ্রামটি এখন বিস্তৃত মাঠ। তবে সেখানে মসুর ডাল, মটরশুটি আর নানা সবজি চাষ হয়। আছে ভূট্টা, কলা ও আখের ক্ষেত। গ্রামটিতে ঢোকা সড়কটি পাশে জমি পেরুলেই চোখে পড়ে একটি পুকুর। এই পুকুরটি মঙ্গলপুরের তিনটি পুকুরের একটি। এর পাশেই দর্গাহর অবস্থান। দরগাহ বলতে শুধু ইট, বালু আর সিমেন্টের মিনার। তাতে লেখা আছে,
' হে আল্লাহ দরগাহ শরীফ মিনার '
পাশে চাদের আকৃতি আঁকা। মিনারের সময়কাল রয়েছে ১৯৭৬ সাল । তা দেখে বোঝা যায় দরগাহ মিনারটি স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের। দরগাহর আশপাশে নিস্তব্ধ পরিবেশ। চারদিক গাছপালায় ঢাকা। স্থানীয়দের অনেকেই বলেন, এখানে মানুষ এসে মানত করেন। যারা যে আশায় মানত করেন, তা পূরণ হয়। দরগাহ আছে অনেক পুরোনো আমল থেকে ।
উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা প্রহল্লাদ রায় বলেন, মঙ্গলপুর নামে একটি গ্রাম আছে। তবে সেখানে কোন ভোটার নেই।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উছেন মে বলেন, গ্রামটিতে এর মধ্যে সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে সাতটি ভূমিহীন পরিবারের জন্য ঘর নির্মাণ করা হয়েছে। সেখানে তারা বসবাস করছেন। পাশে নির্মাণ করা হয়েছে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক। গ্রামটিতে মানুষ না থাকলেও চাষাবাদ হয় বলে শুনেছি। কলেরা মহামারি আকার ধারন করায় অনেক মানুষ মারা যায়। পরে সবাই গ্রাম ছেড়ে যায়।